বিদয়াতীরা , আট রাকায়াত তারাবীহর স্বপক্ষীয় দলীলগুলোর সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা না দিতে পেরে বলে থাকে যে, তারাবীহ্ নামায ও তাহাজ্জুদ নামায একই নামায। রমযান মাসে এটাকে তারাবীহ্ বলে ও রমযান ব্যতীত অন্য মাসে তাহাজ্জুদ বলে।
বিদয়াতীরা , আট রাকায়াত তারাবীহর স্বপক্ষীয় দলীলগুলোর সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা না দিতে পেরে বলে থাকে যে, তারাবীহ্ নামায ও তাহাজ্জুদ নামায একই নামায। রমযান মাসে এটাকে তারাবীহ্ বলে ও রমযান ব্যতীত অন্য মাসে তাহাজ্জুদ বলে।
মূলতঃ বিদয়াতীদের উপরোক্ত বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, তারা অর্থাৎ বিদয়াতীদের শরীয়তের ইলম সম্পর্কে নেহায়েতই অজ্ঞ। কারণ, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায একই নামায নয়।
প্রথমতঃ এটা তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ শব্দের অর্থ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।
প্রথমতঃ এটা তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ শব্দের অর্থ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।
১। তারাবীহ্ শব্দের তাহক্বীক্বী অর্থঃ-
والترويحة فى شهر رمضان= سميت بذالك لا ستراحة القوم بعد كل اربغ ركعات- وفى الحديث صلاة التراويح لا نهم كانوا يستر حون بين كل تسلمتين- والتراويح جمع ترويحة= (لسان العرب ج১ صفه ১৭৬৮، وكذافى القاموس المحيط.
অর্থঃ- রমযান মাসে (তারাবীহ্ নামাযে) প্রতি চার রাকায়াত পর মুসল্লীদের বিশ্রাম নেয়াকে “তারবীহাতুন বলে। প্রতি চার রাকায়াত পর পর মুসল্লীরা বিশ্রাম নেয় বলেই এটাকে তারাবীহ্ নামায বলে। আর “তারাবীহ্” বহুবচন হলো “তারবীহাতুন”-এর। (লিসানুল আরব ১ম জিঃ পৃষ্ঠা-১৭৬৮, অনুরূপ কামূস আল মুহীতে উল্লেখ আছে)
“তারাবীহ্” বহুবচন হলো- “তারবীহাতুন”-এর। যার সাধারণ অর্থ হলো- বসা, অর্থাৎ রমযানের রাত্রে (তারাবীহ্ নামাযে) চার রাকায়াত পর বিশ্রাম নেয়ার জন্যে বসা। প্রত্যেক চার রাকায়াত নামাযকে তারবীহাতুন (ترويحة) বলে। আর পুরো বিশ রাকায়াত নামাযকে তারাবীহ্ (تراويح) বলে, যা রমযান মাসে পড়া হয়। (মিছবাহুল লোগাত পৃষ্ঠা-৩২২, অনুরূপ আল্ মুনজিদেও উল্লেখ আছে।)
“তারাবীহ্” শব্দের অর্থ হলো- বিশ্রাম নেয়া, ঐ বিশ রাকায়াত সুন্নত নামায, যেটা এশার পর ও বিতরের পূর্বে পড়া হয়। যেহেতু প্রত্যেক চার রাকায়াত পর পর কিছু সময় বিলম্ব এবং বিশ্রাম নিতে হয়, তাই এটাকে তারাবীহ্ নামায বলে। (ফিরুযুল লোগাত পৃষ্ঠা-৩৫৩)
অর্থাৎ তারাবীহ্ (تعراويح) শব্দটি হলো- (جمع) বা বহুবচন। তার (واحد) বা একবচন হলো- (ترويحة) তারবীহাতুন। মুহাদ্দিসীনগণের মত হলো- চার রাকায়াত নামাযকে এক “তারবীহাতুন” (ترويحة) বলে, এরূপ পাঁচ তারবীহাতুন (ترويحة) -এ এক তারাবীহ্ (تراريح) । অর্থাৎ ৪*৫=২০, অতএব বিশ রাকায়াতে এক তারাবীহ্।
এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফ-এর বিখ্যাত শরাহ্ উমদাতুল ক্বারীতে উল্লেখ আছে যে,
يقال الترحة اسم لكل اربع ركعة انمافى الاصلى ايصال الراحة وهى الجلسة. (عمدة القارى)
অর্থঃ- প্রতি চার রাকায়াত নামাযকে “তারবীহাতুন” বলা হয়, আর উহা মূলতঃ বিশ্রাম নেয়ার জলসা।
অর্থাৎ প্রতি চার রাকায়াত নামাযের পর বিশ্রাম নেয়া হয় বলেই এটাকে তারবীহাতুন বলে।
অর্থাৎ প্রতি চার রাকায়াত নামাযের পর বিশ্রাম নেয়া হয় বলেই এটাকে তারবীহাতুন বলে।
আর এরূপ পাঁচ তারবীহাতুনে যে বিশ রাকায়াত নিম্নোক্ত বর্ণনা দ্বারা তা স্পষ্টই প্রমাণিত হয়। যেমন এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে –
ان على بن ابى طالب امر رجلا يصلى بنا خمس ترويحات عشربن ركعة. (سنن الكبرى للبيهقى- كنزالعمال)
অর্থঃ- নিশ্চয় হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি এক ব্যক্তিকে আমাদেরকে নিয়ে পাঁচ “তারবীহাত” অর্থাৎ বিশ রাকায়াত নামায পড়ার আদেশ দিয়েছেন। (বায়হাক্বী, কানযুল উম্মাল)
উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে , “পাঁচ তারবীহাতুন”-এ বিশ রাকায়াত, অর্থাৎ বিশ রাকায়াতে এক “তারাবীহ্”। অতএব, তারাবীহ্ শব্দের অর্থ দ্বারাও বিশ রাকায়াত নামায সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
২। তাহাজ্জুদ শব্দের তাহ্ক্বীক্বী অর্থঃ-
“তাহাজ্জুদ শব্দের অর্থ হলো- রাত্রের নামায, আর রাত্রে ঘুম হতে উঠে নামায আদায়কারীকে বলে মুতাহাজ্জিদ। ইমাম আযহারী বলেন, আরবী ভাষায় রাত্রে শয়নকারীকে হাজিদ বলে, আর ঘুম হতে উঠে নামায আদায়কারীকে মুতাহাজ্জিদ বলে। (মিছবাহুল লুগাত পৃষ্ঠা-৯৭৭, অনুরূপ লিসানুল আরব, কামূস আল মুহীত ও আল মুন্জিদেও উল্লেখ আছে)
“তাহাজ্জুদ” শব্দের অর্থ হলো- রাত্রে জাগ্রত হওয়া, ঐ নামায যা অর্ধ রাত্রে উঠে পড়া হয়। (ফিরোজুল লুগাত, পৃষ্ঠা-৩৯৩)
অতএব, “তারাবীহ” ও “তাহাজ্জুদ” শব্দদ্বয়ের তাহ্ক্বীক্ব বা বিশ্লেষণ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায একই নামায নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন নামায। কারণ তারাবীহ্ নামাযের সময় হলো- এশার পর অর্থাৎ তারাবীহ্ নামায যেমন এশার পর পর আদায় করলেও হয়, তদ্রুপ মধ্য রাত্রে ও শেষ রাত্রে অর্থাৎ এশার নামাযের পর হতে সুব্হে সাদিকের আগ পর্যন্ত যে কোন সময় তারাবীহ্ নামায আদায় করা যায়। যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম রাত্রে, মধ্য রাত্রে ও শেষ রাত্রেও তারাবীহ্ নামায আদায় করেছেন।
আর তাহাজ্জুদ নামায মধ্য রাত্রের পূর্বে আদায় করলে ওটা তাহাজ্জুদ নামায হিসাবে গণ্য হবেনা। বরং ওটা রাত্রের নফল নামায হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাযের সময় হলো মধ্য রাত্রের পর হতে সুব্হে সাদিকের আগ পর্যন্ত। তবে তাহাজ্জুদ নামায মধ্য রাত্রের পর ঘুম হতে উঠে আদায় করাই আফজল বা উত্তম।
মূলতঃ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উম্মতে হাবীবীর ইহ্সানের জন্য ও উম্মতে হাবীবীকে সুন্নতে মুয়াক্কাদা তরকের গুণাহ্ হতে হেফাজতের জন্য অর্থাৎ পরবর্তী উম্মতে হাবীবীর জন্য ঘুম হতে উঠে উহা আদায় করা সম্ভব নাও হতে পারে, যদি তারা ঘুমের কারণে উহা আদায় করতে না পারে, তবে সুন্নতে মুয়াক্কাদা তরকের গুণাহে গুণাহগার হবে, তাই তিনি তারাবীহ্ নামাযকে এশার পর পর নিয়ে আসেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন,
والتسى تنامون عنها افضل منالتى تقو مون يريد اخر لليل وكان الناس يقومون اوله.(بخارى شريف)
অর্থঃ- “তোমরা যে সময় ইবাদত না করে ঘুমায়ে থাক, যে সময় হতে ঐ সময়টুকু উত্তম, যে সময় তোমরা নামায পড়। (আব্দুর রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন) উত্তম সময় বলতে তিনি শেষ রাত্রকেই বুঝায়েছেন, কেননা তখন (হযরত উমর উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার সময়) লোকেরা প্রথম রাত্রেই তারাবীহ্ নামায পড়তেন।” (বুখারী শরীফ)
অর্থঃ- “তোমরা যে সময় ইবাদত না করে ঘুমায়ে থাক, যে সময় হতে ঐ সময়টুকু উত্তম, যে সময় তোমরা নামায পড়। (আব্দুর রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন) উত্তম সময় বলতে তিনি শেষ রাত্রকেই বুঝায়েছেন, কেননা তখন (হযরত উমর উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার সময়) লোকেরা প্রথম রাত্রেই তারাবীহ্ নামায পড়তেন।” (বুখারী শরীফ)
অর্থাৎ তারাবীহ্ নামায শেষ রাত্রে পড়াই উত্তম ছিল, কিন্তু হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি উম্মতে হাবীবীর ইহ্সানের জন্য তারাবীহ্ নামায প্রথম রাত্রে এশার নামাযের পর নিয়ে আসেন।
অতএব, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার সময় হতেই নিয়মিতভাবে এশার নামাযের পর তারাবীহ্ নামায আদায় হয়ে আসছে এবং বর্তমানেও সেই সুন্নত তরীক্বাই চালু রয়েছে।
অতএব, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার সময় হতেই নিয়মিতভাবে এশার নামাযের পর তারাবীহ্ নামায আদায় হয়ে আসছে এবং বর্তমানেও সেই সুন্নত তরীক্বাই চালু রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ তারাবীহ্ নামাযে (تداعى) ঘোষণা দেয়া জায়েয। অর্থাৎ তারাবীহ্ নামায ঘোষণা দিয়ে জামায়াতের সাথে আদায় করা হয় বরং তারাবীহ্ নামায জামায়াতে আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। আর তাহাজ্জুদ নামায (تداعى) অর্থাৎ ঘোষণা দিয়ে জামায়াতে আদায় করা মাকরূহ্ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ্, চাই তা রমযান মাসে হোক অথবা গায়রে রমযানে হোক।
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে-
جماعت در تماز تهجد بتداعى مكروه است وبغير تداعى كه اتفاقا ايك دو كس يا سه كس اقتدائى تهحد نمايند مكروه نيست- التداعى بان يقتدى اربعة بواحد كما فى الدرر كذا فى الدرالمختار فاضل ... درحاشيهء شرح وقاية مى ارد- الجماعة فى التهجد الذى هى نافلة بدعة قطعا. (مجموعهء فتاو .. سعديه)
অর্থঃ- ঘোষণা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে আদায় করা মাকরূহ্ তাহরীমী । আর ঘোষণা ব্যতীত একা তাহাজ্জুদ আদায়কারীর পিছনে যদি ঘটনাক্রমে ঊর্দ্ধে তিনজন লোক এক্তেদা করে, (মতবিরোধ রয়েছে, কেউ কেউ বলেন, মাকরূহ্ হবে, কেউ কেউ বলেন, হবেনা) তবে মাকরূহ্ হবেনা। কিন্তু চারজন এক্তেদা করলে (সর্বসম্মতিক্রমে) মাকরূহ্ তাহরীমী হবে। অনুরূপ বর্ণনা দুরার ও দুররুল মুখতার কিতাবেও রয়েছে। আল্লামা ফাযেল চলপী রহমতুল্লাহি আলাইহি শরহে বেকায়ার হাশিয়ায় উল্লেখ করেন যে, তাহাজ্জুদ নামায যেটা নফল নামাযের অন্তর্ভূক্ত, এটা জামায়াতে আদায় করা বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ্। (মজমুয়ায়ে ফতওয়ায়ে সা’দিয়াহ্)
সুতরাং এর দ্বারাও প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ নামায ও তাহাজ্জুদ নামায অভিন্ন নামায নয়, যদি অভিন্নবা একই নামায হতো, তবে তারাবীহ্ নামাযও জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ্ হতো। কারণ ওলামা-ই-কিরামগণের মতে তাহাজ্জুদ নামায রমযান মাসেও জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ্। মূলকথা হলো- তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ একই নামায নয় বরং ভিন্নভিন্ন নামায।
তৃতীয়তঃ তাহাজ্জুদ নামায প্রথমে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ফরজ ছিল, পরবর্তীতে মহান আল্লাহ্ পাক উনার ওহীর মাধ্যমে ওটা মানছূখ বা রদ্ করে দেন। এখন প্রশ্ন হলো- তাহাজ্জুদ নামাযের ফরজের হুকুম যদি রদ্ই হয়ে থাকে, তবে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কেন বললেন,
انى خشيت ان يفرض عليكم.
অর্থাৎ “আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তোমাদের উপর এটা ফরজ হয়ে যায় কিনা।” (বুখারী শরীফ)
মূলতঃ যেটা একবার রদ্ হয়ে গেছে, পূণরায় তা ফরজ হওয়ার কোনই আশঙ্কা থাকতে পারেনা।
সুতরাং এর দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায একই নামায নয় বরং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি রমযান মাসে তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সাথে তারাবীহ্ নামায আলাদা বা পৃথক আদায় করেছেন। আর এই তারাবীহ্ নামায ফরজ হয়ে যাওয়ারই আশঙ্কা করেছেন।
সুতরাং এর দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায একই নামায নয় বরং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি রমযান মাসে তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সাথে তারাবীহ্ নামায আলাদা বা পৃথক আদায় করেছেন। আর এই তারাবীহ্ নামায ফরজ হয়ে যাওয়ারই আশঙ্কা করেছেন।
চতুর্থতঃ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি তাহাজ্জুদ নামাযের নির্দেশ কুরআন শরীফ-এর মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন,
ومن الليل فتهجد ببه نافلة لك ...........
অর্থঃ- রাত্রের কিছু অংশ কুরআন শরীফ পাঠসহ (নামায পড়ার জন্য) জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্য অতিরিক্ত। (বণী ইসরাইল ৭৯)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
ياايها المزمل قم الليل الاقليلا....
অর্থঃ- হে বস্ত্রাবৃত, রাত্রিতে দন্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে ........ (সূরা মুযযাম্মিল১-২)
আর তারাবীহ্ নামায সম্পর্কে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে,
ان الله تبارك وتعالى فرض صيام رمضان عليكم وسننت لكم قيامه. (نسائى شريف)
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন, তোমাদের প্রতি রমযান মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন। আর আমি তোমাদের প্রতি তারাবীহ্ নামাযকে সুন্নত করলাম।” (নাসাঈ শরীফ ১/৩০৮)
এর দ্বারাও প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায ভিন্ন ভিন্ন নামায। কারণ তাহাজ্জুদ নামাযের হুকুম কুরআন শরীফ অর্থাৎ ওহীয়ে মাতলু এর মাধ্যমে এসেছে। আর তারাবীহ্ নামায হাদীছ শরীফ অর্থাৎ ওহীয়ে গায়রে মাতলু এর মাধ্যমে এসেছে। অতএব, এদিক থেকেও উভয় নামাযের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
পঞ্চমতঃ হাদীছ শরীফ-এ তারাবীহ্ নামাযকে قيام رمضان বলা হয়েছে। অর্থাৎ তারাবীহ্ নামায শুধু রমযান মাসের জন্যই খাছ বা নির্দিষ্ট। আর তাহাজ্জুদ নামাযকে বলা হয়েছে, (صلاة لليل) রাত্রের নামায। অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাযকে রমযান মাসের জন্য খাছ বা নির্দিষ্ট করা হয়নি বরং সারা বৎসরের জন্যই খাছ বা নির্দিষ্ট। অতএব, এর দ্বারাও প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ ভিন্ন ভিন্ন নামায।
ষষ্টতঃ তাহাজ্জুদ নামাযের আদেশ মক্কা শরীফ-এ দেয়া হয়েছে, আর তারাবীহ্ নামাযের আদেশ মদীনা শরীফ-এ দেয়া হয়েছে।
সপ্তমতঃ অনুসরণীয় ইমাম মুজ্তাহিদগণ উনাদের কিতাবে তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামাযকে পৃথক নামায হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল মুকান্নাত’-এ উল্লেখ আছে-
التراويح وهى عشرون ركعة يقوم بهافى رمضان فى جماعة ويوتر بعدها فى الجماعة فان كان له تهجد يوتر بعده.
التراويح وهى عشرون ركعة يقوم بهافى رمضان فى جماعة ويوتر بعدها فى الجماعة فان كان له تهجد يوتر بعده.
অর্থঃ- রমযান মাসে বিশ রাকায়াত তারাবীহ্ নামায জামায়াতের সাথে আদায় করবে এবং উহার পর বিতর নামাযও জামায়াতে আদায় করবে। আর যদি কারো তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস থাকে, তবে বিতর তাহাজ্জুদের পর আদায় করবে।”
অতএব যদি তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ একই হতো, তবে আলাদাভাবে তাহাজ্জুদের কথা উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন ছিলনা। সুতরাং এর দ্বারাও প্রমাণিত হলো যে, উল্লেখিত নামাযদ্বয় ভিন্ন ভিন্ন নামায। সাথে সাথে এটাও বুঝা গেলো যে, হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতেও তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ ভিন্ন ভিন্ন নামায।
অষ্টমতঃ হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার হতেও অনুরূপ বর্ণিত আছে-
“হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি রাত্রের প্রথম ভাগে নিজ ছাত্রদের সাথে তারাবীহ্ নামায জামায়াতে আদায় করতেন এবং তাতে একবার কুরআন শরীফ খতম করতেন। আর সাহ্রীর সময় তাহাজ্জুদ নামায একাকী আদায় করতেন।” (লুময়াতুল মাছাবীহ্ , ফতহুল বারী -মুকাদ্দিমা)
“হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি রাত্রের প্রথম ভাগে নিজ ছাত্রদের সাথে তারাবীহ্ নামায জামায়াতে আদায় করতেন এবং তাতে একবার কুরআন শরীফ খতম করতেন। আর সাহ্রীর সময় তাহাজ্জুদ নামায একাকী আদায় করতেন।” (লুময়াতুল মাছাবীহ্ , ফতহুল বারী -মুকাদ্দিমা)
সুতরাং যেখানে হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামাযকে পৃথক নামায মনে করতেন ও পৃথক পৃথকভাবে তা আদায় করতেন, ঊখানে উক্ত নামাযদ্বয়কে একই নামায বলা মূর্খতা ও গুমরাহী বৈ কিছুই নয়।
নবমতঃ তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায পৃথক পৃথক নামায বলেই মুহাদ্দিসীনে কিরাম, হাদীছ শরীফ-এর কিতাবে ও ফুক্কাহায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা ফিক্বাহের কিতাবে উক্ত নামাযদ্বয়কে পৃথক পৃথক অধ্যায়ে বর্ণনা বা উল্লেখ করেছেন। অতএব, যদি একই নামায হতো, তবে তো পৃথক পৃথক অধ্যায় রচনা করার কোন প্রয়োজন ছিলনা। বরং একটি অধ্যায়ই যথেষ্ট ছিল। এর দ্বারাও উক্ত নামাযদ্বয়ের ভিন্নতা প্রমাণিত হয়।
দশমতঃ তাহাজ্জুদ নামাযের রাকায়াতের সংখ্যা নির্দিষ্ট রয়েছে অর্থাৎ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম, ঊর্ধ্বে তেরো রাকায়াত ও নিম্নে সাত রাকায়াত তাহাজ্জুদ নামায পড়েছেন বিতর সহ। আর তারাবীহ্ নামায সম্পর্কে আট রাকায়াত দাবীদারদের অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গেরই বক্তব্য হলো- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হতে তারাবীহ্ নামাযের নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা প্রমাণিত নেই। যেমন এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে-
قال علامة السبكى اعلم انه لم ينقل كم صلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فى تلك لليالى هل هو عشرون او اقل. (شرح المنهاج)
অর্থঃ- আল্লামা সুবকী বলেন, রমযান মাসে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ রাকায়াত তারাবীহ্ পড়েছেন, না কম পড়েছেন, উহা বর্ণিত নেই। (শরহে মিনহাজ)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, যদিও তাদের উপরোক্ত বক্তব্যটি অশুদ্ধ বা ভুল, তথাপি তাদের উক্ত বক্তব্য দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ একই নামায নয়, যদি একই হতো, তবে (তাদের মতে) তারাবীহ্ নামাযের রাকায়াতের সংখ্যা অনির্দিষ্ট হতোনা বরং তাহাজ্জুদ নামাযের ন্যায় নির্দিষ্টই হতো।
উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায কখনোই এক নামায নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন নামায। উক্ত নামাযদ্বয়কে একই নামায হিসাবে আখ্যায়িত করা মূলতঃ নিজেদের মূর্খতা ও গুামরাহীকে আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত করারই নামান্তর। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায যেহেতু একই নামায নয়, সেহেতেু হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত ‘বুখারী শরীফ’-এর হাদীছ শরীফখানাও আট রাকায়াত তারাবীহ্ নামাযের পক্ষে দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয় বরং উক্ত হাদীছ শরীফখানা তাহাজ্জুদ নামাযের দলীল হিসাবেই গ্রহণযোগ্য।
উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায কখনোই এক নামায নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন নামায। উক্ত নামাযদ্বয়কে একই নামায হিসাবে আখ্যায়িত করা মূলতঃ নিজেদের মূর্খতা ও গুামরাহীকে আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত করারই নামান্তর। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামায যেহেতু একই নামায নয়, সেহেতেু হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত ‘বুখারী শরীফ’-এর হাদীছ শরীফখানাও আট রাকায়াত তারাবীহ্ নামাযের পক্ষে দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয় বরং উক্ত হাদীছ শরীফখানা তাহাজ্জুদ নামাযের দলীল হিসাবেই গ্রহণযোগ্য।
সূতরাং তারাবীহ ও তাহাজ্জুদকে একই বলে তাদের এ দাবী বা বক্তব্য সম্পূর্ণই অমূলক, বিভ্রান্তিকর, মনগড়া, বানোয়াট, অজ্ঞতাপ্রসূত ও অপপ্রচার মাত্র। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সকলকে এ ধরণের গুমরাহী ও অপপ্রচার থেকে হিফাজত করুন।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, হাদীছ শরীফে তারাবীহ্ নামাযকে (قيام ضهر رمضان) ক্বিয়ামু শাহরে রামাদান, (قيام لليل) ক্বিয়ামুল লাইল ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর ক্বিয়ামু রামাদান যে, তারাবীহ্ নামায, এ ব্যাপারে সকলেই একমত। যেমন এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
قال الكرمانى- اتفقوا على ان المراد بقيام رسمضان
التراويح- وبه جزم النووى وغيره (اوجزالمسالك)
التراويح- وبه جزم النووى وغيره (اوجزالمسالك)
অর্থঃ- আল্লামা কিরমানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, “ক্বিয়ামু রামাদান” দ্বারা তারাবীহ্ নামাযকে বুঝানো হয়েছে। ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও অন্যান্যগণের এটাই অভিমত। (আওযাযুল মাসালিক)
এ প্রসঙ্গে কিতাবে আরো উল্লেখ আছে যে,
وفى الاقناع- اتفقوا على ان التراويح هى المراد من قوله صلى الله عليه وسلم قام رمضان وفى شرح الكبير- التراريح هى قيام رمضان.
অর্থঃ- আল্ ইক্বনা কিতাবে উল্লেখ আছে, সকলেই একমত যে, قام رمضان হাদীছ শরীফ দ্বারা তারাবীহ্ নামাযকে বুঝানো হয়েছে। আর “শরহুল কবীরে” বর্ণিত আছে যে, “ক্বিয়ামু রামাদান” অর্থে তারাবীহ্ নামাযকেই বুঝানো হয়েছে। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যে সকল হাদীছ শরীফে قام رمضان ক্বিয়ামু রামাদান উল্লেখ আছে, ওটার দ্বারা মূলতঃ তারাবীহ্ নামাযকেই বুঝানো হয়েছে। আর “ক্বিয়ামুল লাইল” (قيام لليل) তারাবীহ্ নামায হওয়ার ব্যাপারে যদিও মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তবে অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণের মতে ক্বিয়ামুল লাইল অর্থে তারাবীহ্ নামাযকেই বুঝানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
“অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ, “ক্বিয়ামুল লাইল” দ্বারা তারাবীহ্ নামাযকে বুঝিয়েছেন।” (আহসানুল ফতওয়া, অনুরূপ- হেদায়া, ফতহুল ক্বাদীর, মাব্ছূত ও বাদায়েতে উল্লেখ আছে)
“অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ, “ক্বিয়ামুল লাইল” দ্বারা তারাবীহ্ নামাযকে বুঝিয়েছেন।” (আহসানুল ফতওয়া, অনুরূপ- হেদায়া, ফতহুল ক্বাদীর, মাব্ছূত ও বাদায়েতে উল্লেখ আছে)
তাছাড়া হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে যে, جعل الله صيامه قريضة وقيام ليله تطوع- (بيهقى شريف)
অর্থঃ- “তোমাদের জন্য মহান আল্লাহ্ পাক তিনি রমযানের রোজাকে ফরজ করেছেন এবং “ক্বিয়ামুল লাইল” অর্থাৎ রাত্রের নামাযকে (তারাবীহ্কে) নফল (সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্) করেছেন।” (বায়হাক্বী শরীফ)
অর্থঃ- “তোমাদের জন্য মহান আল্লাহ্ পাক তিনি রমযানের রোজাকে ফরজ করেছেন এবং “ক্বিয়ামুল লাইল” অর্থাৎ রাত্রের নামাযকে (তারাবীহ্কে) নফল (সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্) করেছেন।” (বায়হাক্বী শরীফ)
মূলতঃ উক্ত হাদীছ শরীফে তারাবীহ্ নামাযকে “ক্বিয়ামুল লাইল” (قيام لليل) বলা হয়েছে। অতএব, মূলকথা হলো- ক্বিয়ামু রামাদান قيام رمضان ও ক্বিয়ামুল লাইল قيام لليل হাদীছ শরীফে তারাবীহ্ নামাযের অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
Comments
Post a Comment