সমগ্র পৃথিবীতে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাতীয় ভাবে পালন হতো তার প্রমাণ



সমগ্র বিশ্বে এক নামে স্বীকৃত একজন মুহাদ্দিস হচ্ছেন হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। আজ থেকে পাঁচশত বছর পূর্বে উনার জন্ম। তিনি ইলমে হাদীসের জ্ঞান অর্জন করতে মক্কা শরীফ শরীফ মদীনা শরীফ সব স্থানে ভ্রমন করেন। সকল মাদ্রাসায় পঠিত এবং সকল উছুলে হাদীস শরীফের কিতাবে উনার নাম স্ব মহিমায় উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াচ্ছে। তাঁর রচিত মেশকাত শরীফ এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ “মেরক্বাত শরীফ” সারা পৃথিবীতে একটি আলোড়ন সৃষ্টি কারী কিতাব। তিনি সারাটা জীবন অসংখ্য কিতাব রচনা করে মুসলিম জাহানের জন্য এক বিশাল নিয়ামত রেখে গিয়েছেন। 

উনার অসংখ্য কিতাবের মধ্যে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থের নাম হচ্ছে “আল মাওরিদুর রাভী ফি মাওলিদিন নাব্যিয়”। এ কিতাবে তিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হাবীবুল্লাহ হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আগমন তথা মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ থেকে দলীল পেশ করেছেন। এবং সেই সাথে একটা বিষয় উল্লেখ করেছেন সেটা হচ্ছে, “সারা পৃথিবীর সকল দেশে যে যাঁকজমকের সাথে ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন হতো তার ঐতিহাসিক প্রনান উল্লেখ করেছেন।” আমরা উক্ত কিতাব থেকে সে ঐতিহাসিক বর্ননা গুলো উল্লেখ করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ !


(১) মক্কা শরীফ বাসীর মীলাদ :
“আমাদের মাশায়েখদের ইমাম শায়খ শামসুদ্দিন মুহম্মদ সাখাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, পবিত্র মক্কা শরীফে মীলাদ শরীফ অনুষ্ঠানে যারা কয়েক বছর উপস্থিত ছিলেন, আমি তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। আমরা মীলাদ শরীফ অনুষ্ঠানের বরকত অনুভব করছিলাম যা নিদৃষ্ট কয়েক ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। এ অনুষ্ঠানের মধ্যেও হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্মস্থানের যিয়ারত আমার কয়েকবার হয়েছে। ….
আল্লামা সাখাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আরো বলেন, মক্কাবাসী বরকত ও কল্যানের খনি। তাঁরা সে প্রসিদ্ধ পবিত্র স্থানের প্রতি বিশেষ মনোনিবেশ করেন, যেটা হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্মস্থান। এটা সাউকুল লাইলে অবস্থিত। যাতে এর বরকতে প্রত্যেকের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এসব লোক মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দিন আরো অনেক কিছুর আয়োজন করে থাকেন। এ আয়োজনে আবেদ, নেককার, পরহিজগার, দানবীর কেউই বাদ যায় না। বিশেষ করে হেজাজের আমীর বিনা সংকোচে সানন্দে অংশ গ্রহন করেন এবং উনার আগমন উপলক্ষে ঐ জায়গায় এক বিশেষ নিশান তৈরী করা হত। পরবর্তীতে এটা মক্কা শরীফে বিচারক ও বিশিষ্ট আলেম আল-বুরহানিশ শাফেয়ী মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলক্ষ্যে আগত যিয়ারতকারী খাদেম ও সমবেত লোকদের খানা ও মিষ্টি খাওয়ানো পছন্দনীয় কাজ বলে রায় দিয়েছেন।”


(২) মদীনা শরীফ বাসীদের মীলাদ শরীফ মাহফিল :
” মদীনা শরীফ বাসিগনও মীলাদ শরীফ মাহফিলের আয়োজন করতেন এবং অনুরুপ অনুৃষ্ঠানাদি পালন করতেন। বাদশাহ মোজাফফর শাহ আরিফ অধিক আগ্রহী এবং সীমাহীন আয়োজনকারী ছিলেন। হযরত ইমাম আবু শামা রহমাতুল্লাহি আলাইহি যিনি ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার অন্যতম উস্তাদ এবং বিশেষ বুজুর্গ ছিলেন, স্বীয় কিতাব “আল বায়াছ আলাল কদয়ে ওয়াল হাওয়াদিছে” বাদশাহের প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন এরকম ভালো কাজ সমূহ তার খুবই পছন্দ এবং তিনি এধরনের অনুষ্ঠান পালনকারীদের উৎসাহ প্রদান ও প্রশংসা করতেন। ইমাম জাজরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আরো সংযোজন করে বলেন, এসব অনুষ্ঠানাদী পালন করার দ্বারা শয়তানকে নাজেহাল এবং ঈমানদারদের উৎসাহ উদ্দীপনা দানই উদ্দেশ্যে হওয়া চাই।”


(৩) মিসর ও সিরিয়াবাসীর মীলাদ শরীফ:
” মীলাদ শরীফ মাহফিলে সবচাইতে অগ্রগামী ছিলেন মিসর ও সিরিয়াবাসি। মিসরের সুলতান প্রতি বছর পবিত্র বিলাদত শরীফের রাত্রে মীলাদ শরীফ মাহফিলের আয়োজনের অগ্রনী ভূমিকা রাখতেন। ইমাম সামছুদ্দীন সাখাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ননা করেন আমি ৭৮৫ হিজরীতে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রাতে সুলতান বরকুকের উদ্যোগে আলজবলুল আলীয়া নামক কেল্লায় আয়োজিত মীলাদ শরীফ মাহফিলে হাজির হয়েছিলাম। ওখানে আমি যা কিছু দেখেছিলাম, তা আমাকে অবাক করেছে অসীম তৃপ্তি দান করেছে। কোনোকিছুই আমার কাছে অসস্থিকর লাগেনী। সে পবিত্র রাতে বাদশার ভাষন, উপস্থিত বক্তাগনের বক্তব্য, কারীগনের তেলাওয়াতে কুরআন শরীফ, এবং নাত শরীফ পাঠকারীগনের না’ত আমি সাথে সাথে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছি।”


(৪) স্পেন ও পাশ্চাত্য দেশে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন :
” স্পেন ও পাশ্চাত্য শহরগুলোতে পবিত্র মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতে রাজা বাদশাহগন জুলুস বের করতেন। সেথায় বড় বড় ইমাম ও ওলামায়ে কিরামগন অংশ গ্রহণ করতেন। মাঝ পথে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এসে তাঁদের সাথে যোগ দিতেন এবং কাফিরদের সামনে সত্য বানী তুলে ধরতেন। আমি যতটুকু জানি , রোমবাসীগনও কোন অংশে পিছিয়ে ছিলো। তারাও অন্যান্য বাদশাহগনের মত মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহফিলের আয়োজন করতেন।”


(৫) অনারব দেশে তথা ভারতবর্ষে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:
” আরব ছাড়াও অনারবে মীলাদ শরীফ মাহফিলের প্রচলন ছিলো মহাসমারোহে।যেমন- পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে এবং মহিমান্বিত দিনে এসকল এলাকার অধিবাসীদের মীলাদ শরীফ মাহফিলের নামে জাঁকজমক পূর্ন মজলিসের আয়োজন হতো গরীব মিসকিনদের মধ্যকার বিশেষ ও সাধারণ সকলের জন্য বহু ধরনের খাবারের বন্দোবস্ত করা হত। তাতে ধারাবাহিক তেলাওয়াত বহু প্রকার খতম এবং উচ্চাঙ্গ ভাষায় প্রসংসা সম্বলিত কবিতা আবৃত্তি হতো। বহু বরকতময় ও কল্যানময় আমলের সমাহার ঘটতো বৈধ পন্থায় আনন্দ প্রকাশ করা হতো, বহু বিখ্যাত আলেমগনও তাতে অংশ গ্রহণ করতেন।….মুঘল বাদশাহ হুমায়ুনও বিশাল জাকজমকের সাথে প্রতিবছর মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহফিলের আয়োজন করতেন…!“

দলীল-√ আল মাওরিদুর রাভী ফি মাওলিদিন নাবিয়্যি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।লেখক – ইমামুল মুহাদ্দেসীন হযরত মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। ওফাত : ১০১৪ হিজরী।


সম্মানিত পাঠক বৃন্দ ! দেখুন সারা দুনিয়াতে আজ থেকে ৫০০/৬০০ বছর আগেও সমগ্র দেশ ব্যাপী দেশের বাদশাহ এবং জনগন সবাই মিলে ব্যাপক ভাবে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন করতেন। এবং সে সকল মাহফিলে উপস্থিত থাকেন তখনকার যুগ শ্রেষ্ঠ আলেম এবং ইমামগন। তখন পৃথিবীর যমীনে কোন মানুষই এর বিরোধিতা করে নাই। কোন আপত্তি করে নাই।
তবে আজ ২০/২৫ বছর ধরে কোন নব্য দল উদয় হলো যে, এরা এই যুগযুগ ধরে চলে আসা এই বরকতময় আমলের বিরোধিতা করে ? মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন হারাম নাজায়িয বলে কোন সাহসে ? এই নব্য উদিত ফেৎনা ওহাবী/সালাফী/জামাতি/ দেওবন্দী খারেজীদের কে অধিকার দিয়েছে মনগড়া ফতোয়া দেয়ার ?

Comments

Popular posts from this blog

বিদআতের পরিচয়, বিদআত কাকে বলে কত প্রকার ও কী কী বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

আরবীতে ‘কুল্লু/কুল্লুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রত্যেক।কিন্তু সবসময় এ শব্দটি দ্বারা ‘প্রত্যেক/সকল’ অর্থ বুঝায় না।

তাবলীগ করা কি সবার জন্য ফরজ?