ঐতিহাসিক সুমহান ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ’ ছফর মাসের শেষ ইয়াওমুল আরবিয়ায়ি বা বুধবার শরীফ। যা কুল কায়িনাতের সকলের জন্য এক সুমহান ঈদ বা খুশির দিন।





পবিত্র আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ উনাকে নিয়ে আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট খুবই অবহেলার। কোনো পত্র-পত্রিকা মিডিয়া ফলাও করে বলে না, লিখে না যে আজ পবিত্র আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ। বলে না যে, আজকের আমলে মুসলমানদের জন্য এই এই ফযীলত। তুলে ধরে না এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য।

কোনো স্কুল-কলেজ অধিকাংশ মাদরাসার শিক্ষকগণ ও শিক্ষার্থীদের জানায় না যে, আগামীকাল বা আজ মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পবিত্র আখিরী চাহার শোম্বাহ । তোমরা বাড়িতে গিয়ে এটা-সেটা করবে। পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনকে উৎসাহিত করবে। এছাড়া অভিভাবক মহলও কেমন যেন, তারাও খবর রাখে না আখিরী চাহার শোম্বাহ শরীফ কি, কখন, কেমনইবা তার আমল। মূলত, এগুলোর মাধ্যমে মুসলমান উনাদের হীনতা-দীনতা তথা হীনম্মন্যতাই ফুটে উঠেছে। মুসলমান উনাদের ঐতিহ্য ভুলে যাবে, স্বকীয়তাকে বিনষ্ট করে দিবে, শুধু দুনিয়া তালাশে ব্যস্ত থাকবে, আবার নিজেকে মুসলমান ঈমানদার বলে দাবি করবে, সেটা হতে পারে না। উনাদেরকে অবশ্যই নিজেদের পবিত্র দ্বীন ইসলামের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং সেগুলোকে যথাযথ মর্যাদার সাথে উদযাপনের চেষ্টা করতে হবে।
‘আখির’ শব্দটি ভাষাগত দিক থেকে আরবী; যদিও তা ফার্সী ও উর্দূতে ব্যবহার হয়। এর অর্থ শেষ। আর ‘চাহার শোম্বাহ’ হচ্ছে ফার্সী শব্দ। এর অর্থ বুধবার। আরবী ও ফার্সী শব্দের সংমিশ্রণে ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ’ বলতে ছফর মাসের শেষ বুধবারকে বুঝানো হয়ে থাকে। মূলত এ দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিশেষ খুশির দিন।
এ মুবারক দিনটি সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, রহমতুল্লিল আলামীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিদায়ের পূর্ববর্তী মাসের অর্থাৎ ১১ হিজরী সনের ছফর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি ভীষণভাবে অসুস্থতা অনুভব করেন অতঃপর দিন দিন উনার অসুস্থতার অনুভব বাড়তেই থাকে। কিন্তু এই মাসের ৩০ তারিখ বুধবার দিন ভোর বেলা ঘুম থেকে জেগে তিনি বললেন, ‘আমার নিকট কে আছেন?’ এ কথা শুনামাত্রই উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি ছুটে আসলেন এবং বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আমি হাযির আছি।’ তখন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, ‘হে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম! আমার মাথা মুবারক-এর ব্যথা দূর হয়ে গেছে এবং শরীর মুবারকও বেশ হালকা মনে হচ্ছে। আমি আজ বেশ সুস্থতা বোধ করছি।’ সুবহানাল্লাহ! এ কথা শুনে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং তাড়াতাড়ি পানি আনয়ন করে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মাথা মুবারক ধুয়ে দিলেন এবং সমস্ত শরীর মুবারক-এ পানি ঢেলে ভালোভাবে গোসল করিয়ে দিলেন।
এই গোসলের ফলে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম উনার শরীর মুবারক হতে বহু দিনের অসুস্থতাজনিত অবসাদ অনেকাংশে দূর হয়ে গেল। তারপর তিনি বললেন, ‘হে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম! ঘরে কোনো খাবার আছে কি?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘জী-হ্যাঁ, কিছু রুটি পাকানো আছে।’ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, ‘আমার জন্য তা নিয়ে আসুন আর হযরত মা ফাতিমাতুয যাহরা আলাইহাস সালাম উনাকে খবর দিন, তিনি যেন উনার আওলাদগণ উনাদেরকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার নিকট চলে আসেন।’ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি সাইয়্যিদাতুন নিসা হযরত ফাতিমাতুয যাহরা আলাইহাস সালাম উনাকে সংবাদ দিলেন এবং ঘরে যে খাবার তৈরি ছিলো তা হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট পরিবেশন করলেন।
সাইয়্যিদাতুন নিসা হযরত ফাতিমাতুয যাহরা আলাইহাস সালাম উনার আওলাদগণ উনাদেরকে নিয়ে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট হাজির হলেন। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত মা ফাতিমাতুয যাহরা আলাইহাস সালাম উনাকে নিজের গলা মুবারক-এর সাথে জড়িয়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন, নাতিগণ উনাদের কপাল মুবারক-এ চুমো খেলেন এবং উনাদেরকে সাথে নিয়ে আহারে বসলেন। কয়েক লোকমা খাবার গ্রহণ করার পর অন্যান্য উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনারাও খিদমতে এসে হাযির হলেন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে বিশিষ্ট ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও বাইরে এসে হাযির হন। কিছুক্ষণ পর হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বাইরে এসে উনাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম! আমার বিদায়ের পর আপনাদের অবস্থা কিরূপ হবে?’ এ কথা শুনে হযরত ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনারা ব্যাকুলচিত্তে কান্না শুরু করলেন। উনাদের এ অবস্থা দেখে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদেরকে সান্তনা দান করলেন। অতঃপর হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মসজিদে নববী শরীফ-এ ওয়াক্তিয়া নামাযের ইমামতি করলেন।
আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থতা অনুভব করার পর সুস্থতা অনুভব করে মসজিদে নববী শরীফ-এ আগমন করেন এবং নামাযের ইমামতি করেন এই অপার আনন্দে হযরত ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনারা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে অনেক কিছু হাদিয়া পেশ করেন। কোনো কোনো বর্ণনায় জানা যায় যে, খুশিতে খুশি হয়ে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম তিনি সাত হাজার দীনার, হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম তিনি পাঁচ হাজার দীনার, হযরত উছমান যুন নূরাইন আলাইহিস সালাম তিনি দশ হাজার দীনার, হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি তিন হাজার দীনার, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি একশত উট ও একশত ঘোড়া মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় হাদিয়া করতঃ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহব্বত ও সন্তুষ্টি লাভ করেন।
মূলকথা হলো- আজ ঐতিহাসিক সুমহান ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ’। অর্থাৎ ছফর মাসের শেষ ইয়াওমুল আরবিয়ায়ি বা বুধবার শরীফ। যা কুল কায়িনাতের সকলের জন্য এক সুমহান ঈদ বা খুশির দিন। এ উপলক্ষে সকলের জন্য আবশ্যক হচ্ছে- খুশী প্রকাশ করে সাধ্যমতো হাদিয়া পেশ করা, দান-ছদক্বা করা, গোসল করা, ভালো খাওয়া, অধিক পরিমাণে মীলাদ শরীফ, দুরূদ শরীফ পাঠ করা।

Comments

নতুন পোস্ট সমূহ

বিদআতের পরিচয়, বিদআত কাকে বলে কত প্রকার ও কী কী বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

পবিত্র সূরা ইউনুস শরীফের ৫৭-৫৮ নম্বর আয়াত শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা

তাবলীগের অর্থ ও তাবলীগের প্রকার।

আরবীতে ‘কুল্লু/কুল্লুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রত্যেক।কিন্তু সবসময় এ শব্দটি দ্বারা ‘প্রত্যেক/সকল’ অর্থ বুঝায় না।

তাবলীগ করা কি সবার জন্য ফরজ?

কিশোরী আয়েশা সিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার বিয়ে নিয়ে বিদ্বেষীদের মিথ্যাচার!!

কুরআন ও হাদিসের আলোকে মিলাদুন্নবী

যারা বলে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফের দিন খুশী প্রকাশ করা যাবে না, তাদের বক্তব্যের দাঁতভাঙ্গা জবাব

~~~~~~~~~~~ শরীয়তে ঈদ কয়টি ? ~~~~~~~~~~~

ইসলামে জন্মদিন পালন করা কি প্যাগানদের থেকে এসেছে? ইহুদী, খ্রিস্টানদের কালচার? ইসলামী শরীয়ত জন্মদিন পালন সম্পর্কে কি বলে ?